ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না
ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না
Share
"ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না" হুমায়ুন আজাদের একটি প্রখ্যাত এবং প্রগাঢ়ভাবে ভাবনার উদ্রেককারী প্রবন্ধগ্রন্থ, যা ১৯৯৮ সালে প্রকাশিত হয়। এই বইতে হুমায়ুন আজাদ তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, দুঃখ-কষ্ট, সমাজের অবস্থা, এবং সাহিত্যিক জীবনের নানা দিক নিয়ে লিখেছেন। এটি একটি আত্মজীবনীমূলক এবং চিন্তাশীল প্রবন্ধ সংকলন, যেখানে লেখক নানা সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিষয় নিয়ে গভীর চিন্তা-ভাবনা করেছেন।
বইটির সারাংশ:
"ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না" হুমায়ুন আজাদের জীবনবোধ এবং সামাজিক দর্শনের একটি সাহসী প্রকাশ। বইটির নাম থেকেই বোঝা যায় যে লেখক ফুলের সৌন্দর্য বা আরামপ্রদ দৃশ্যের প্রতি নিঃসন্দেহে এক ধরনের বিরক্তি বা হতাশার অনুভূতি প্রকাশ করছেন। তিনি জানাচ্ছেন, সুন্দর, সরল বা সুশ্রুত জিনিসও এক সময় মানুষকে বিভ্রান্তি এবং অস্থিরতা দিতে পারে। বইটিতে আজাদ তাঁর দুঃখ, হতাশা, রাজনৈতিক পরিস্থিতি, জীবনের অসঙ্গতি এবং একাকীত্ব নিয়ে তার খোলামেলা চিন্তা প্রকাশ করেছেন।
বইটির মূল বিষয়:
1. বেকায়দা সমাজ ও সংস্কৃতি: হুমায়ুন আজাদ তাঁর লেখায় বাংলাদেশের সমাজের অসঙ্গতি এবং সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি সমাজের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন, যেখানে মানুষ সত্যের পরিবর্তে ভ falsas বা হঠকারি বিশ্বাসে বিশ্বাসী। বিশেষ করে, ধর্মীয় গোঁড়ামি, রাজনীতির অস্থিরতা, এবং সামাজিক অসহিষ্ণুতা নিয়ে আজাদের হতাশা খুব স্পষ্ট।
2. বিকৃত রাজনৈতিক পরিবেশ: বইয়ে দেশের রাজনৈতিক পরিবেশের প্রতি আজাদের অসন্তোষ ফুটে উঠেছে। তিনি তাঁর লেখায় বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে সরাসরি সমালোচনা করেছেন। তাঁর মতে, বাংলাদেশে জনগণের ভাবনা ও অধিকার অনেক সময় উপেক্ষিত হয় এবং ক্ষমতা একচেটিয়া হাতে চলে আসে।
3. নির্বিঘ্ন সমাজের প্রতি বিরক্তি: বইয়ের প্রবন্ধগুলোতে আজাদ এমন এক সমাজের চিত্র এঁকেছেন, যেখানে ব্যক্তি তার নিজের স্বাধীনতা এবং চিন্তার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, এবং সমাজের অস্বাভাবিক নিয়মকানুনের মধ্যে তাকে বাঁচতে হয়। তিনি দেখান যে, একজন ব্যক্তি যখন সমাজের কুশিক্ষা ও দমন-পীড়নের শিকার হন, তখন তার জন্য নিজের জীবনকে অর্থপূর্ণ করা কঠিন হয়ে পড়ে।
4. ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা: "ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না" বইটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার একটি সংকলন, যেখানে লেখক তাঁর নিজের জীবনের নানা দুঃখ-কষ্ট, হতাশা, একাকীত্ব এবং আত্মবিশ্বাসের সংকট নিয়ে আলোচনা করেছেন। এখানে হুমায়ুন আজাদ তাঁর লেখক হিসেবে সমাজের উপর প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেছেন এবং সেই সঙ্গে তার ব্যক্তিগত জগৎও তুলে ধরেছেন।
5. দার্শনিক চিন্তা: হুমায়ুন আজাদ তার লেখার মধ্যে জীবনের গভীর তত্ত্ব এবং দার্শনিক ভাবনা প্রবাহিত করেছেন। তিনি প্রশ্ন করেছেন, মানুষ কেন সুখী হতে পারে না? কেন আমরা আমাদের নিজস্ব সত্য খুঁজে পেতে অক্ষম? তিনি এইসব প্রশ্নে উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু কোথাও কোনো নির্দিষ্ট সমাধান দিতে পারেননি।
লেখার শৈলী:
হুমায়ুন আজাদের লেখার শৈলী অসাধারণভাবে সোজা, তীক্ষ্ণ এবং চিন্তাশীল। তিনি প্রায়শই গভীর দার্শনিক চিন্তা এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সঙ্গে সমাজের প্রেক্ষাপট মিশিয়ে এমন একটি ভাষায় লিখেছেন, যা পাঠককে ভাবতে বাধ্য করে। তাঁর লেখার মধ্যে থাকে এক ধরনের গম্ভীরতা এবং বোধগম্যতার সংমিশ্রণ, যা পাঠকের মনকে প্রবলভাবে আকৃষ্ট করে।
সমালোচনা:
বইটি পড়ে কিছু পাঠক মনে করেছেন যে, হুমায়ুন আজাদ কখনও কখনও অতিরিক্ত নৈরাশ্যবাদী বা হতাশাময় হয়ে যান। তাঁর এই আত্মবিশ্বাসী এবং সমাজের প্রতি অবিশ্বাসের গভীরতা কিছু পাঠককে অস্বস্তিতে ফেলতে পারে। তবে অনেকেই তাঁর লেখার তীক্ষ্ণতা এবং আধুনিক চিন্তার জন্য প্রশংসা করেছেন।
উপসংহার:
"ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না" হুমায়ুন আজাদের একটি অমূল্য সাহিত্যকর্ম, যা তার দার্শনিক চিন্তা, সমাজের প্রতি হতাশা, এবং ব্যক্তিগত যন্ত্রণার এক গভীর চিত্র তুলে ধরে। এটি আমাদের সমাজের ভেতরকার অসঙ্গতি, ব্যক্তিগত জীবনের সংকট এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার দিকে আলোকপাত করে, যা একদিকে যেমন ভাবনার উদ্রেক করে, অন্যদিকে আমাদের জীবনের কিছু সত্য মেনে নিতে বাধ্য করে। এটি সাহিত্যের একটি শক্তিশালী পঠনযোগ্য বই, যা আধুনিক চিন্তা এবং সমাজের প্রতি এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে।