
দেশভাগের অর্জন
Reliable shipping
Flexible returns
বই রিভিউ: "দেশভাগের অর্জন" - জয়া চ্যাটার্জী
জয়া চ্যাটার্জী রচিত "দেশভাগের অর্জন" ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়কে বিশ্লেষণ করে। বইটি ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পরবর্তী অর্জন, বিরোধ, এবং এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাবের উপর আলোকপাত করে, যা এই অঞ্চলের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কাঠামোকে ব্যাপকভাবে বদলে দিয়েছে।
বইটির সারসংক্ষেপ:
"দেশভাগের অর্জন" বইটি ভারতের ১৯৪৭ সালের দেশভাগকে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক পরিবর্তন হয়েছিল, তা বিশ্লেষণ করে। দেশভাগের প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান এবং ভারত উভয়ের জন্য যে "অর্জন" হয়েছিল, সেগুলির দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। তবে, বইটির মধ্যে শুধু অর্জন নয়, দেশভাগের ফলে যে অপ্রত্যাশিত ক্ষত এবং শোষণ সৃষ্টি হয়েছে, তার উপরও গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
জয়া চ্যাটার্জী দেশভাগের পর ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের পাকিস্তানে স্থানান্তর, পাকিস্তানের পক্ষে বাঙালি মুসলিমদের জীবনযাপন, এবং ভারতের মধ্যে ধর্মীয় দাঙ্গা এবং সামাজিক ভাঙনের বিষয়গুলো বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি দেশভাগের মধ্যে বাঙালি জাতির অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম এবং পাকিস্তানের পক্ষে তাদের প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিচয় সম্পর্কে গভীর দৃষ্টিভঙ্গি উপস্থাপন করেছেন।
মূল আলোচনা:
১. রাজনৈতিক অর্জন ও সীমাবদ্ধতা:
দেশভাগের পর ভারত এবং পাকিস্তান পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও, এর পরবর্তী রাজনীতি একেবারে সহজ ছিল না। পাকিস্তান বিশেষত, পূর্ব বাংলা বা বর্তমান বাংলাদেশ, একদিকে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠিত আদর্শের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেছিল, অন্যদিকে ভারতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং সংখ্যালঘুদের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক ছিল। চ্যাটার্জী এই অর্জন এবং পরবর্তী রাজনৈতিক সংকটকে সংজ্ঞায়িত করেছেন।
2. ধর্মীয় এবং সামাজিক বিভেদ:
বইটির আরেকটি বড় দিক হল ধর্মীয় বিভাজন এবং এর প্রভাব। দেশভাগের ফলে মুসলিম, হিন্দু, শিখ এবং অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে যে বিরোধ শুরু হয়েছিল, তা এই গ্রন্থে নিখুঁতভাবে চিত্রিত করা হয়েছে। সমাজে ধর্মীয় পরিচয়ের প্রতি যে নির্ভরতা বেড়ে গিয়েছিল এবং মানুষের মানবিক সম্পর্কগুলিতে যে বৈষম্য এবং ঘৃণা প্রবাহিত হয়েছিল, তার পেছনে রাজনৈতিক কারণ ও বিভাজন কতটা দায়ী, সেসব বিষয়ের উপর লেখক আলোচন করেছেন।
3. পাকিস্তানে বাঙালি মুসলমানের অবস্থা:
দেশভাগের পর পাকিস্তানে বসবাসকারী বাঙালি মুসলমানদের সংগ্রাম এবং পাকিস্তানের মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্নতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। জয়া চ্যাটার্জী এই বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণভাবে তুলে ধরেছেন, যেখানে বাঙালিদের সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং পাকিস্তান সরকারের প্রতি তাদের অসন্তোষের চিত্র ফুটে উঠেছে।
4. পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার বিভাজন:
দেশভাগের ফলস্বরূপ পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার মধ্যে সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক বিরোধ তৈরি হয়েছিল, যা বিশেষ করে বাঙালির জন্য এক ঐতিহাসিক দুর্ভোগ হয়ে দাঁড়ায়। পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে যে রাজনৈতিক উন্নতি হয়েছিল এবং পূর্ববাংলার জনগণের সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি তৈরি হয়েছিল, তার বিশ্লেষণ করেছেন চ্যাটার্জী।
কাঠামো ও লেখনী শৈলী:
জয়া চ্যাটার্জীর লেখনী অত্যন্ত সুসংহত এবং গবেষণামূলক। তিনি শুধু ঘটনার বর্ণনা দেননি, বরং সে ঘটনার পেছনের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর উপস্থাপনাগুলি সুষম এবং তথ্যসমৃদ্ধ, যা পাঠকদের বইয়ের প্রতি আকর্ষণ সৃষ্টি করে। তিনি যে বিশ্লেষণ করেছেন, তা শুধুমাত্র ঘটনাবলী নয়, বরং তৎকালীন জনগণের অনুভূতি ও রাজনৈতিক অবস্থানকেও স্পষ্ট করেছে।
বিশেষ বৈশিষ্ট্য:
রাজনৈতিক এবং সামাজিক দৃষ্টিকোণ: বইটি শুধুমাত্র ইতিহাসের ঘটনা বর্ণনা নয়, বরং দেশভাগের ফলে সৃষ্ট সামাজিক ও রাজনৈতিক ফলাফলগুলোর ব্যাপক বিশ্লেষণ করেছে।
বাঙালি মুসলমানদের সংগ্রাম: পাকিস্তানে বাঙালি মুসলমানদের অবস্থা এবং তাদের সংগ্রামের মধ্যে যে চাপ ছিল, তা বইটির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
ধর্মীয় বিভেদ ও তার প্রভাব: চ্যাটার্জী ধর্মীয় বিভাজনের ফলস্বরূপ উত্থান হওয়া ঘৃণা ও সামাজিক সংঘর্ষের বিষয়টিকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন।
উপসংহার:
"দেশভাগের অর্জন" একটি চিন্তাশীল এবং গভীরভাবে গবেষণামূলক বই, যা ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের একটি অন্ধকার অধ্যায়কে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়ন করে। এটি যে কোনো পাঠকের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ, বিশেষ করে যারা দেশভাগ এবং তার পরবর্তী রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তন সম্পর্কে জানার জন্য আগ্রহী। বইটি শুধু ইতিহাসের পাঠকদের জন্য নয়, বরং এটি সমাজ, রাজনীতি, এবং সংস্কৃতি নিয়ে চিন্তা করতে উৎসাহিত করে।