ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান
Share
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান – লেনিন আজাদ
প্রকাশনী: ১৯৯১
লেখক: লেনিন আজাদ
ভূমিকা:
লেনিন আজাদের "ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান" একটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসগ্রন্থ, যা ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের পটভূমি, তার কারণ, প্রেক্ষাপট এবং এর ফলাফল বিশ্লেষণ করে। বইটি ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান বা '৬৯ সালের জনতার বিদ্রোহ'কে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অন্ধকার এবং বিপ্লবী মুহূর্তকে চিত্রিত করে। এটি একদিকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়, অন্যদিকে গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের আকাঙ্ক্ষা এবং একনায়কত্বের বিরুদ্ধে তাদের সংগ্রামের গল্প।
প্লট:
এই বইটি ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান বা 'ঊনসত্তরের আন্দোলন' নিয়ে একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ। লেখক লেনিন আজাদ অত্যন্ত বিস্তারিতভাবে এ আন্দোলনের শুরু, এর মূল কারণ, তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর একনায়কত্ব এবং বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রাম সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। ১৯৬৯ সালে একাত্তরের আগে এই আন্দোলনটি ছিল বাংলাদেশের মানুষের গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রথম বড় অগ্নিপরীক্ষা। বইটি আন্দোলনের মধ্যে সঙ্গী হওয়া নেতা, সংগঠন, ছাত্রদের ভূমিকা, এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের সময়কার রাজনৈতিক পরিবেশকে বিশ্লেষণ করে।
গণঅভ্যুত্থান চলাকালীন প্রধান চরিত্র ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান, যাঁকে 'বঙ্গবন্ধু' হিসেবে পরিচিতি পায় এবং ছাত্ররা, শ্রমিকরা, বুদ্ধিজীবীরা, এবং সাধারণ মানুষ—সবাই মিলে পাকিস্তানি শাসনের বিরুদ্ধে এক জোরালো অবস্থান নেন। লেখক তৎকালীন আন্দোলনের ধরণ, জনমত, ছাত্র রাজনীতি, পাকিস্তানি শাসকদের নীতি এবং তাঁদের আচরণ পর্যালোচনা করেছেন।
মূল থিম:
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান বইটির মূল থিম হলো একনায়কত্বের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম এবং জনগণের শক্তি ও সাহসের মহিমা। বইটির মাধ্যমে লেখক ১৯৬৯ সালের আন্দোলনের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং তৎকালীন জনগণের দাবির গভীরতা প্রকাশ করেছেন। পাকিস্তানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালির অঙ্গীকার এবং স্বাধীনতার জন্য তাদের সংগ্রাম এখানে অত্যন্ত সুচারুভাবে উপস্থাপিত হয়েছে।
এছাড়া, এটি ছাত্র আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন এবং সাধারণ মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের এক সংগ্রামগাথা। লেখক চিহ্নিত করেছেন কীভাবে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন দিগন্তের সূচনা করেছিল এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতার পথে যে অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল তার ধারাবাহিকতা কীভাবে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পরিণত হয়েছিল।
লেখার ধরন:
লেনিন আজাদ অত্যন্ত সুসংহত ও তথ্যভিত্তিক ভাষায় এই বইটি লিখেছেন। তাঁর ভাষার সরলতা এবং বিস্তারিত বিশ্লেষণ পাঠককে আকর্ষণ করে, কারণ লেখক কোনো ঘটনা বা ঘটনার পেছনের কারণগুলো বিশ্লেষণ করতে অত্যন্ত মনোযোগী। বইটির মধ্যে রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট খুব ভালোভাবে আলোচনা করা হয়েছে, যা একাধিক দৃষ্টিকোণ থেকে ঘটনাগুলোর গুরুত্বকে তুলে ধরে।
সমালোচনা:
বইটি গবেষণাধর্মী এবং তথ্যসমৃদ্ধ হওয়ায় এটি ইতিহাসের ছাত্রছাত্রী, রাজনীতির বিশ্লেষক, এবং সাধারণ পাঠকদের জন্য একটি অমূল্য সম্পদ। তবে, এর কিছু জায়গায় একাধিক তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও রাজনৈতিক ভাষার ব্যবহার কিছু পাঠকের জন্য কঠিন হতে পারে। বিশেষ করে যারা সাধারণ বা কাল্পনিক গল্প পড়তে পছন্দ করেন, তারা হয়তো এটি একটু ভারী বা গবেষণাধর্মী মনে করতে পারেন।
উপসংহার:
"ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান" লেনিন আজাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক গ্রন্থ, যা ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানকে ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে চিত্রিত করেছে। এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক স্মরণীয় সংগ্রামের কাহিনী, যেখানে জনগণ তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছে। বইটি শুধু ইতিহাসের এক অধ্যায় নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধের পূর্ববর্তী বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক চিত্রও ফুটিয়ে তোলে। এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রতি আগ্রহী পাঠকদের জন্য এক অমূল্য উৎস।