আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর (আবুল মুনসুর আহমদ)
আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর (আবুল মুনসুর আহমদ)
Share
আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর – আবুল মনসুর আহমদ
প্রকাশনী: ১৯৬৯
লেখক: আবুল মনসুর আহমদ
ভূমিকা:
আবুল মনসুর আহমদের "আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর" বাংলা সাহিত্যে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক স্মৃতিকথা, যা তার জীবনের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা, বাংলাদেশ তথা উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং স্বাধীনতার পূর্ববর্তী বাংলাদেশের রাজনীতির বিভিন্ন দিক নিয়ে লেখা। এটি শুধু একজন রাজনৈতিক নেতার ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণ নয়, বরং ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৭ পর্যন্ত পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের রাজনীতির একটি অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। লেখক তাঁর নিজের জীবন, সংগ্রাম, এবং রাজনীতির প্রতি নিবেদিত সম্পর্কের মাধ্যমে একটি ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ তুলে ধরেছেন।
প্লট:
বইটি লেখকের জীবনের পঞ্চাশ বছরের রাজনৈতিক যাত্রার বিশদ বর্ণনা। এই সময়কালে তিনি পাকিস্তানের স্বাধীনতা, পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি, রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে সংঘর্ষ, এবং বিশেষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের দিকে এগিয়ে যাওয়া সম্পর্কিত নানা ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন। বইয়ের মাধ্যমে তিনি রাজনৈতিক আদর্শ, দলীয় সংঘর্ষ, গণতন্ত্রের প্রতি জনগণের আকাঙ্ক্ষা, এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলেছেন।
আবুল মনসুর আহমদ তাঁর রাজনৈতিক জীবন ও সময়ে ঘটিত গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর চিত্র তুলে ধরেছেন, যেমন পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণমূলক সম্পর্ক, ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পরবর্তী পরিস্থিতি, রাজনৈতিক নেতাদের চরিত্র, এবং একনায়কত্বের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিবাদ। লেখক পাকিস্তানের রাজনৈতিক জীবনের বহু অজানা দিক প্রকাশ করেছেন, বিশেষ করে বাংলার রাজনীতির অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি, নেতৃত্বের সংকট, এবং বাংলাদেশকে স্বাধীনতার দিকে নিয়ে যাওয়ার পটভূমি।
মূল থিম:
"আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর" বইটির মূল থিম হলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবর্তন, একনায়কত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে সংগ্রাম। এতে লেখক একদিকে পাকিস্তানি শাসকদের শোষণমূলক মনোভাব, অন্যদিকে বাংলার জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াইয়ের ইতিহাস তুলে ধরেছেন।
বইটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের চিত্র তুলে ধরে, যেমন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের বৈষম্য, রাজনৈতিক আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, এবং ১৯৬৬ সালে শেরেবাংলা একে ফজলুল হকের "ছয় দফা" আন্দোলন। লেখক এসব বিষয়ে বিস্তারিতভাবে মন্তব্য করেছেন এবং তাঁর নিজের রাজনৈতিক চেতনা ও আদর্শের কথা বলেছেন।
লেখার ধরন:
আবুল মনসুর আহমদের লেখনীর ধরন গভীর এবং সোজাসাপটা। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতাগুলো সরাসরি এবং স্বচ্ছভাবে তুলে ধরেছেন, যা পাঠকের কাছে অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য। ভাষার প্রাঞ্জলতা এবং তথ্যের নির্ভুলতা তার লেখার শক্তি। লেখক কোনো রাজনৈতিক ঘটনা বা সিদ্ধান্তের পেছনে থাকা কারণ এবং তার ফলাফল ব্যাখ্যা করতে পছন্দ করেছেন, যা বইটিকে অত্যন্ত শিক্ষণীয় ও তথ্যসমৃদ্ধ করে তোলে।
এছাড়া, বইটি একটি রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করেছে, যা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার পাশাপাশি একটি বৃহত্তর রাজনৈতিক ধারণা প্রদান করে। তার ব্যাখ্যাগুলি রাজনৈতিক তত্ত্ব, দেশপ্রেম, এবং মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে প্রাধান্য দেয়।
সমালোচনা:
এই বইটি ঐতিহাসিক রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে অমূল্য হলেও, কিছু পাঠক হয়তো এর লেখনীর গাম্ভীর্য এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটের গভীরতা বুঝতে অসুবিধা পেতে পারেন। তবে, যেহেতু এটি একটি রাজনৈতিক স্মৃতিকথা, তাই ইতিহাসের প্রতি আগ্রহী পাঠকদের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও মানসম্পন্ন একটি বই।
উপসংহার:
"আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর" আবুল মনসুর আহমদের একটি মূল্যবান রাজনৈতিক সঙ্গী, যা পাকিস্তান, বিশেষভাবে পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) রাজনৈতিক ইতিহাসের গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে। বইটি শুধুমাত্র রাজনৈতিক সংগ্রামের কথা নয়, বরং ২০শ শতকের প্রথমার্ধে বাংলার রাজনৈতিক চেতনা এবং মুক্তির জন্য তীব্র সংগ্রামের চিত্রও অঙ্কিত করে। এটি বাংলাদেশের রাজনীতি এবং মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর ঘটনাগুলি বোঝার জন্য এক অমূল্য দলিল। রাজনৈতিক ইতিহাসে আগ্রহী পাঠকদের জন্য এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।