আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম
আমরা কি এই বাঙলাদেশ চেয়েছিলাম
Share
"আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম?" হুমায়ুন আজাদের একটি অত্যন্ত প্রভাবশালী প্রবন্ধগ্রন্থ, যা ২০০৩ সালে প্রকাশিত হয়। এই বইটি একটি গভীর, সৎ এবং সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ প্রদান করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে। লেখক তার ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ এবং তীক্ষ্ণ ভাষায় দেশের অবস্থা এবং তার পরিবর্তন সম্পর্কে প্রশ্ন তোলেন।
বইটির সারাংশ:
এই বইয়ে হুমায়ুন আজাদ মূলত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে দেশের যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তাতে হতাশা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, আমরা কি সত্যিই সেই স্বাধীনতা চেয়েছিলাম, যা অর্জন করেছি? আমাদের জাতীয় জীবনের বিভিন্ন দিক যেমন রাজনৈতিক দুর্নীতি, সামাজিক অবক্ষয়, ধর্মীয় অন্ধত্ব এবং শিক্ষা ব্যবস্থার বিপর্যয় নিয়ে তিনি খোলামেলা আলোচনা করেছেন।
আজাদ তাঁর লেখায় অনেক সময়ে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং ভবিষ্যত দিক নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তিনি মনে করেন, একটি জাতি হিসেবে আমরা স্বাধীনতা অর্জনের মূল লক্ষ্য থেকে অনেক দূরে সরে গেছি এবং মানুষের মৌলিক অধিকার, বাক স্বাধীনতা এবং মানবাধিকারের প্রতি অবজ্ঞা বেড়েছে।
বইটির প্রধান বিষয়বস্তু:
1. স্বাধীনতার অমীমাংসিত প্রশ্ন: হুমায়ুন আজাদ প্রশ্ন করেন, আমাদের স্বাধীনতা কি সত্যিই একটি জনগণের স্বাধীনতা ছিল, না কি তা শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তন ছিল? তিনি স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সরকার এবং রাজনৈতিক দলগুলোর আচরণ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
2. ধর্ম এবং সমাজ: বইটির একটি বড় অংশ জুড়ে আছে ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং মৌলবাদী শক্তির বিরুদ্ধে আজাদের তীব্র সমালোচনা। তিনি বলেছেন, ধর্ম আমাদের স্বাধীনতা এবং সামাজিক মূল্যবোধের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
3. সামাজিক অবক্ষয়: তিনি বাংলাদেশে সামাজিক অবক্ষয় এবং নৈতিকতার অবনতির ব্যাপারে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি মানুষের আস্থা হারানো, শিক্ষাব্যবস্থার দুরবস্থা, দুর্নীতির বিস্তার ইত্যাদি বিষয়গুলো তিনি তুলে ধরেছেন।
4. ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও সংস্কৃতি: হুমায়ুন আজাদ ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং মৌলিক মানবাধিকার নিয়ে আলোচনা করেছেন এবং সমাজের যে অগ্রগতির জন্য এগুলি অপরিহার্য, তা সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে মতামত দিয়েছেন।
বইটির শৈলী:
হুমায়ুন আজাদের লেখার শৈলী অত্যন্ত তীক্ষ্ণ এবং রসালো। তিনি প্রায়শই ব্যঙ্গ, রসিকতা, এবং চ্যালেঞ্জিং মন্তব্য ব্যবহার করেন, যা পাঠককে ভাবাতে এবং ভাবনা-চিন্তা করতে বাধ্য করে। তাঁর লেখা কখনওই একগুঁয়ে বা একপাক্ষিক নয়, বরং এটি খোলামেলা, মুক্ত চিন্তার প্রতি আহ্বান জানিয়ে থাকে। তার ভাষার মাধুর্য এবং প্রাঞ্জলতা পাঠকদের কাছে খুব সহজেই গ্রহণযোগ্য।
সমালোচনা:
অনেকেই "আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম?" বইটি পড়ে হুমায়ুন আজাদের সাহসিকতা এবং সরলতায় মুগ্ধ হয়েছেন। তবে কিছু পাঠক এই বইয়ের তীব্র সমালোচনামূলক ভাষা এবং নৈরাশ্যবাদী দৃষ্টিকোণকে কঠিন মনে করেছেন। এই বইয়ে দেশপ্রেমের চেয়ে বেশি নিন্দা, হতাশা ও পরিতাপ ফুটে উঠেছে, যা কিছু পাঠককে অস্বস্তিতে ফেলতে পারে।
উপসংহার:
"আমরা কি এই বাংলাদেশ চেয়েছিলাম?" একটি শক্তিশালী এবং চিন্তাশীল প্রবন্ধ, যা আমাদের দেশের বাস্তবতা এবং ভবিষ্যত নিয়ে গভীর প্রশ্ন তোলে। হুমায়ুন আজাদ বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে তার নিজস্ব দৃঢ় মতামত প্রকাশ করেছেন, যা একদিকে যেমন তীব্রভাবে সমালোচনামূলক, অন্যদিকে দেশপ্রেমিক। এই বইটি বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অবস্থা সম্পর্কে চিন্তা করতে বাধ্য করে এবং একটি বড় প্রশ্ন উত্থাপন করে—আমরা আসলে কি চেয়েছিলাম?